সরোজ কান্তি দেওয়াঞ্জী ,
বাংলার সবুজে মোড়া নাটোরের ভাটপাড়া গ্রামে একদিন জন্ম নিল এক কন্যা— নাম ভবানী। ছোট্ট মেয়েটি ছিল অতি মেধাবী, শান্ত স্বভাবের, আর দেবতার প্রতি গভীর ভক্তি ছিল তার। পিতা বাণেশ্বরী চক্রবর্তী ছিলেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত; তিনি মেয়েকে শুধু বিদ্যা নয়, ন্যায়ের বোধ ও দয়ার পাঠও শিখিয়েছিলেন।
দিন যায়, কিশোরী ভবানী সৌন্দর্য ও জ্ঞানে গ্রামজুড়ে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। সেই সময় নাটোর রাজ্যের অধিপতি রাজা রামজীবন রায় তাঁর গুণে মুগ্ধ হয়ে বিয়ে করেন ভবানীকে। ছোটবেলায় যে মেয়েটি পিতার কাছে ধর্মশাস্ত্র পড়ত, সেই মেয়েই একদিন হয়ে উঠল রাজবাড়ির রানী।

রাজ্যের ভার রানি হাতে
রামজীবন রায়ের মৃত্যুর পর রাজ্যের ভার এসে পড়ে তরুণী ভবানীর কাঁধে। কিন্তু এই নারী ভয় পাননি— তিনি রাজ্য চালাতে শুরু করলেন দৃঢ় হাতে।
তিনি শুনতেন প্রজার অভিযোগ, পরামর্শ দিতেন মন্ত্রীদের, আর রাজ্যের প্রতিটি কোণ যেন মায়ের মতো নিজের চোখে রাখতেন।
প্রজারা তাঁকে ডাকতে শুরু করল —
“আমাদের মা, আমাদের রানি ভবানী।”

প্রজাদের জন্য রানি
এক বছর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে সারা রাজ্য কাঁপছে। ধান নেই, খাদ্য নেই, শিশুরা কাঁদছে ক্ষুধায়।
রানি ভবানী রাজবাড়ির ধনভাণ্ডার খুলে দিলেন —
“প্রথমে আমার প্রজারা বাঁচুক, তারপর রাজত্ব!”
তাঁর নির্দেশে চাল, ডাল, কাপড় বিনা মূল্যে বিতরণ হলো। তিনি কর মওকুফ করলেন, ঘরে ঘরে খাদ্য পাঠালেন। প্রজারা বলল,
“রানি শুধু রাজা নন, তিনি দেবী!”
ধর্ম ও দান
রানি ভবানী ছিলেন গভীরভাবে ধর্মপ্রাণ। তিনি বাংলার নানা স্থানে মন্দির, দীঘি, রাস্তা, ধর্মশালা নির্মাণ করেন।
পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত তারাপীঠ মন্দির,
কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির–এর পাশেই তাঁর দানের স্মৃতি আজও জেগে আছে।তিনি নিজের অর্থে ব্রাহ্মণ, দরিদ্র ও ভিক্ষুদের সহায়তা করতেন। তাঁর দান এত ব্যাপক ছিল যে ইংরেজরাও তাঁকে “The Queen of Natore” নামে সম্বোধন করত।
শেষ জীবন ও কাশীর দিনগুলো
বার্ধক্যে তিনি রাজকার্য থেকে সরে গিয়ে কাশীতে চলে যান। সেখানে তিনি শান্তভাবে ভক্তি ও দানে জীবন কাটাতে লাগলেন। প্রতিদিন গঙ্গার তীরে বসে ধ্যান করতেন, প্রজাদের খোঁজ নিতেন, চিঠিতে উপদেশ পাঠাতেন নাটোরে।
১৭৯৫ সালের এক শান্ত সন্ধ্যায়, গঙ্গার ধারে বসে নাম জপ করতে করতে রানি ভবানী চিরনিদ্রায় শায়িত হন।
কাশীর আকাশে ভেসে উঠেছিল এক কথাই —“আজ এক দেবী বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে।”
রানি ভবানীর উত্তরাধিকার
আজও নাটোরের রাজবাড়ির দেওয়ালে তাঁর পদচিহ্ন রয়ে গেছে। দীঘির জলে, মন্দিরের ঘন্টায়, মানুষের মুখে মুখে—
রানি ভবানী বেঁচে আছেন, এক ন্যায়পরায়ণ ও দয়ালু নারীর প্রতীক হয়ে।