সরোজ কান্তি দেওয়াঞ্জী ,
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দেবদাস এক অমর চরিত্র—ভালোবাসা, বেদনা ও আত্মবিধ্বংসের প্রতীক। তার জীবন শুরু হয়েছিল এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে, কিন্তু শেষ হয়েছিল এক করুণ ও নিঃসঙ্গ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
শৈশব ও প্রেমের শুরু
দেবদাস ছিল বঙ্গদেশের তৎকালীন বর্ধমান জেলার তালসোনাপুর গ্রামের জমিদার নারায়ণ মুখার্জির ছেলে। পাশের জমিদার পরিবারের মেয়ে পার্বতী (পারো) তার শৈশবসঙ্গিনী। ছোটবেলা থেকেই দুজনের মধ্যে ছিল গভীর স্নেহ, হাসি-ঠাট্টা আর এক মধুর বন্ধন, যা পরে রূপ নেয় প্রেমে।
কিন্তু সামাজিক মর্যাদা, পরিবারের অহংকার এবং ধর্মীয় ভেদাভেদ এই ভালোবাসার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দেবদাসের বাবা চাননি তার ছেলে কোনো নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করুক। অপরদিকে পারো’র পরিবারও অপমান সহ্য করতে না পেরে দ্রুত তার বিয়ে ঠিক করে দেন এক ধনী, বয়সে বড় জমিদারের সঙ্গে—ভবানীপুর গ্রামের বিধবা জমিদার ব্রজবন বাবুর সঙ্গে।

বিচ্ছেদ ও আত্মবিনাশ
এই বিচ্ছেদ দেবদাসকে ভেতর থেকে ভেঙে দেয়। সে কলকাতায় চলে আসে এবং মদের নেশায় ডুবে যায়।
ওখানেই তার দেখা হয় এক গণিকা চন্দ্রমুখীর সঙ্গে। কিন্তু চন্দ্রমুখীর ভালোবাসা সত্ত্বেও দেবদাস তার অতীতের প্রেম ভুলতে পারে না। প্রতিদিন মদ খেতে খেতে তার দেহ ও মন ভেঙে পড়তে থাকে।
চন্দ্রমুখী তার যত্ন করে, কিন্তু দেবদাস মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে নিজের হাতে।

শেষ যাত্রা
এক রাতে সে সিদ্ধান্ত নেয়—
“মরে যাব, কিন্তু তার আগে একবার পারোকে দেখে যাব।”
তার দুর্বল শরীর নিয়েই সে রেলগাড়িতে ওঠে, গন্তব্য — মনোহরপুর গ্রাম, পারো’র শ্বশুরবাড়ি।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, একেবারে ভোররাতে সে পৌঁছে যায় পারোদের গ্রামের কাছে। তখন শরৎকাল, হালকা কুয়াশায় ঢেকে আছে মাঠ। দেবদাসের হাতে তখনও ছিল ছোট্ট এক অ্যালুমিনিয়ামের পানির বোতল, যার ভেতরে একটু মদ অবশিষ্ট।

মৃত্যুর দৃশ্য
রাত শেষ হওয়ার আগে, ক্লান্ত ও অসুস্থ দেবদাস টলতে টলতে গিয়ে পৌঁছায় পারো’র বাড়ির সামনের বটগাছের নিচে। তার মুখ শুকনো, ঠোঁট ফেটে গেছে, চোখে শুধু একটিই আকাঙ্ক্ষা—পারোকে একবার দেখা।
কিন্তু তার আর শক্তি নেই কারো নাম ডাকারও। সে মাটিতে বসে পড়ে, তারপর ধীরে ধীরে শুয়ে যায়।
রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে আসে ভোর। ভোরবেলা গ্রামের লোকজন দেখতে পায়, পার্বতীর বাড়ির সামনে এক অচেনা লোক মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়ে আছে। খবর ছড়িয়ে যায়—
“একজন লোক মরেছে বড়বউঠানের দরজার সামনে!”
পার্বতী খবর পেয়ে দৌড়ে আসে জানালার পাশে। কিন্তু তখন সমাজের নিয়ম তাকে বাইরে যেতে দেয় না। জানালার ফাঁক দিয়ে সে চেয়ে দেখে—
মাটির ওপর শুয়ে আছে দেবদাস, তার মুখে এক শান্ত হাসি, ঠোঁটে শেষ নিঃশ্বাস থেমে আছে যেন পারোর নামেই।

শেষ নিঃশ্বাস
ঠিক ভোর ৫টার দিকে, মনোহরপুর গ্রামের পারো’র বাড়ির দরজার সামনে, দেবদাস শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
তার মৃতদেহের পাশে পড়ে ছিল ফাঁকা মদের বোতল আর এক পুরোনো রুমাল, যেখানে পারো’র নাম লেখা ছিল।
লোকেরা জানত না সে কে, শুধু নাম জানতে পেরেছিল — “দেবদাস মুখার্জি”।
গ্রামের লোকেরা তাকে নদীর ঘাটে দাহ করে, আর পারো জানালার আড়াল থেকে নীরবে কাঁদে।
শেষ উপলব্ধি
দেবদাসের মৃত্যু ছিল এক দহন, যা সমাজ, অহংকার, ও নিজের দুর্বলতার ফল।
সে মরেছিল ভালোবাসার জন্য — সেই ভালোবাসা, যা কখনও পূর্ণ হয়নি।