জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দ্বিতীয় দিনের মতো সাক্ষ্য দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম। সাক্ষ্যে তিনি বলেন, ‘নতুন সরকার গঠনের পূর্বপ্রস্তুতির অংশ হিসেবে আমরা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। ৪ আগস্ট আমরা তাকে নতুন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দিই। আন্দোলনের সময় গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারের ইচ্ছামতো বিবৃতি না দেওয়ায় আমাকে অপহরণ করে আয়নাঘরে আটক রাখা হয় এবং নৃশংসভাবে নির্যাতন চালানো হয়।’
বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ ৪৭তম সাক্ষী নাহিদ ইসলামের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। এদিন বেলা সোয়া ১১টা থেকে ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দেন নাহিদ ইসলাম। জবানবন্দি শেষে দুপুরে বিরতি দেওয়া হয়। বিরতির পর বিকাল ৪টা পর্যন্ত তাকে জেরা করেন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। তবে জেরা শেষ না হওয়ায় রোববার পর্যন্ত মুলতুবি করেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের বাকি সদস্যরা হলেন-বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম।
নাহিদ ইসলাম তার জবানবন্দিতে আরও জানান, ‘২০ জুলাই রাতে আমি খবর পাই যে সরকার কারফিউ ঘোষণা করেছে এবং কারফিউ চলাকালে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেদিন রাতে আমি নন্দীপাড়ার এক বন্ধুর বাসায় অবস্থান করি। রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে কয়েকজন লোক সেখানে এসে আমাকে হাতকড়া পরিয়ে ও চোখে কালো কাপড় বেঁধে একটি প্রাইভেট কারে তোলে। গাড়িতে ওঠানোর পরপরই তারা আমাকে মারধর শুরু করে।
পরে আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে কয়েক ঘণ্টা পরপর আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পুরো সময় আমার হাতকড়া ও চোখ বাঁধা অবস্থায় রাখা হয়। তারা জানতে চাইছিল কারা আন্দোলনে জড়িত এবং কেন আন্দোলন থামানো যাচ্ছে না। জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়, এতে আমি কয়েকবার অজ্ঞান হয়ে যাই।
তারা আমাকে জানায় যে আমাকে গুম করা হয়েছে এবং যদি আন্দোলন না থামাই, তবে আর কখনো মুক্তি পাব না। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর গভীর রাতে আমাকে পূর্বাচলের একটি ব্রিজের পাশে চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। সেখান থেকে আমি নিজ বাসা বনশ্রীতে ফিরে যাই। পরে আমার পরিবার আমাকে ঢাকার গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি করে।’
তিনি বলেন, ‘৪ আগস্ট আমরা শাহবাগে অবস্থান ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করি। সেদিন ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করি। সরকার কারফিউ জারি করে। দেশব্যাপী ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়। আমরা জানতে পারি, সরকার ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ব্যর্থ করার উদ্দেশ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেবে, আমাদের হত্যা ও গুম করা হতে পারে। তাই আমরা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করি।’
সরকার পতনের ঘোষণার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সমন্বয়ক ও অন্যান্য ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র সংগঠন যেমন: ছাত্রদল, ছাত্রশিবির এবং বামপন্থি কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা করি। একদফায় আমরা ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাই।’
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘৫ আগস্ট সারা দেশের মানুষ ঢাকায় আসতে থাকে। তারা শাহবাগে অবস্থান গ্রহণের চেষ্টা করে। শহীদ মিনার ও চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো হয়। সেনাবাহিনী একপর্যায়ে রাস্তা ছেড়ে দিলে তারা শাহবাগে অবস্থান গ্রহণ করেন। কিছুক্ষণের মধ্যে শাহবাগ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। আর আমরা শুনতে পাই-যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা দিয়ে লাখ লাখ মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করছে। শাহবাগ থেকে মিছিল নিয়ে আমরা গণভবনের উদ্দেশে রওয়ানা দিই। পথে সংবাদ পাই, গণবিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে গেছেন। সেদিন সন্ধ্যায় আমরা সংবাদ সম্মেলন করে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন এবং সব বন্দির মুক্তির দাবি করি। কোনো ধরনের সেনাশাসন বা সেনাসমর্থিত শাসন মেনে নেব না বলেও ঘোষণা দিই।’
৫ আগস্ট ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের খবর পান বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এই নৃশংস ঘটনার জন্য শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা সরাসরি দায়ী।’
শেখ হাসিনার পাশাপাশি এ মামলার অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়েছেন এবং ইতিমধ্যেই ট্রাইব্যুনালে তার জবানবন্দি দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার তাকে আদালতে হাজির করা হয়।
আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলেননি শেখ হাসিনা : সাক্ষী হিসাবে নাহিদ ইসলামের দেওয়া জবানবন্দি জেরায় প্রত্যাখ্যান করেন শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। তিনি বলেন, সারা দেশে আন্দোলনে কোনো বাধা দেয়নি সরকার। শেখ হাসিনাও আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বা নাতিপুতি বলেননি। তার কথার মর্ম সঠিকভাবে না বুঝে আন্দোলন তীব্রতর করা হয়েছিল। জেরার জবাবে সাক্ষী বলেন, মূলত আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বা নাতিপুতি বলে আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের উসকানি দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা গ্রেফতার না হওয়ায় অসন্তোষ নাহিদের : সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে সাংবাদিকদের নাহিদ ইসলাম বলেন, কিছু সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের গুলি করার অভিযোগ রয়েছে। তাদের গত এক বছরেও গ্রেফতার করা হয়নি। আমি নিজেও গুম কমিশনে অভিযোগ দিয়েছি। তিনি বলেন, যারা রামপুরা-বাড্ডসহ বিভিন্ন স্থানে গুলি চালিয়েছে, মানুষ হত্যা করেছে তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না। কোনো চাপ আছে কি না জানি না। আমি সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই, অবিলম্বে এদের গ্রেফতার করে আইনি ব্যবস্থা নেবে।
প্রত্যাশা অনুযায়ী মিডিয়া সংস্কার হয়নি : নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে গণমাধ্যমের বিভিন্ন রুল ছিল। আবার বিভিন্ন সময় কিছু গণমাধ্যম আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। সেময় ফ্যাসিবাদের পক্ষেও যেমন ছিল, আবার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধেও অনেক ছিল। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী মিডিয়া সংস্কার হয়নি। যদিও আমিও দায়িত্বে ছিলাম। মিডিয়া এখনো নিয়ন্ত্রিত বলে আমি মনে করি। ডিজিএফআই আগে যেভাবে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ বা বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশ করত, এখনো সেই চর্চা রয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি যে সময়টুকু দায়িত্ব পেয়েছিলাম, আমরা গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠন করেছিলাম। তাদের দায়িত্ব ছিল পুরো বিষয়টা সংস্কার প্রস্তাবনা করে সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা। এছাড়া বিভিন্ন অভিযোগে হওয়া সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলার পর্যালোচনা নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। যেন এসব মামলা প্রসঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়। তারা সুপারিশও করেছিল। বাকিটা আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল। অর্থাৎ সংবাদকর্মী হিসাবে যারা ফ্যাসিবাদের দোসর ছিলেন, তাদের বিচারের আওতায় আনার।’
হাবিবুরসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন, বিচার শুরু ১৬ অক্টোবর
রাজধানীর রামপুরায় ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেনকে গুলি করে হত্যা ও আরও একজনকে হত্যার মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল-১ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেছে। একই সঙ্গে বিচার শুরুর নির্দেশ দিয়ে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের তারিখ হিসেবে আগামী ১৬ অক্টোবর নির্ধারণ করা হয়েছে।