Dark
Light
Today: October 15, 2025
September 5, 2025
21 mins read

ফিলিস্তিনি সাংবাদিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে কী ভাবছেন ইসরায়েলি গণমাধ্যমকর্মীরা?

গাজায় গত সোমবার (২৫ আগস্ট) খান ইউনিসের একটি হাসপাতালে ইসরায়েলি সেনাদের হামলায় আরও পাঁচজন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় মোট ১৮৯ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।

বিপরীতে অদূরেই থাকা ইসরায়েলি সাংবাদিকেরা পুরোপুরি নীরব ছিলেন দুই বছর ধরে। সোমবারের হত্যাকাণ্ডের পর অবশ্য ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট ইন ইসরায়েল একটি বিরল—হোক তা দায়সারা—বিবৃতি দিয়ে সেই নীরবতা সামান্য ভঙ্গ করেছে। বিবৃতিতে তারা ‘গভীরভাবে শোকাহত’ বলে জানিয়েছে। তবে ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের প্রতি কোনো রকম সংহতি প্রকাশ করেনি, কোনো রকম সহমর্মিতা জানায়নি, সহকর্মী হিসেবে কোনো ক্ষোভ জানায়নি।

অনেক বছর আগে যখন হারেৎজ–এর প্রতিনিধি হিসেবে পশ্চিম তীর ও গাজার সংবাদ সংগ্রহের কাজ করতাম, তখন আমি ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের সঠিক, নির্ভরযোগ্য ও পেশাদার প্রতিবেদনের ওপর ভীষণভাবে নির্ভর করতাম। কোনো রকম আর্থিক প্রাপ্তিযোগ ছাড়াই তাঁরা তাঁদের সময় ও শ্রম ব্যয় করতেন ইসরায়েলি সাংবাদিকদের সহযোগিতা করার জন্য। তাঁরা বেশির ভাগই ছিলেন দেশপ্রেমী ও গর্বিত ফিলিস্তিনি, যাঁরা বিশ্বাস করতেন যে ফিলিস্তিনিদের কাহিনিগুলো ইসরায়েলি গণমাধ্যমের সাহায্যে ইসরায়েলি জনগণের সামনে তুলে ধরা গেলে তাঁদের অবস্থাটা জানানো যাবে।

আমি একাই নই। আমরা সহকর্মীরা, অন্যান্য ইসরায়েলি ও বৈশ্বিক গণমাধ্যমের পশ্চিম তীর ও গাজার প্রতিনিধিরা একই কাজ করেছেন। নাবুলেস নামের একজন ফিলিস্তিনি আমার সহকর্মী ছিলেন প্রথম ইন্তিফাদার সময়। তিনি ফিলিস্তিনি দৈনিক আল-কুদস–এর প্রতিনিধি হিসেবে পশ্চিম তীরের উত্তরাঞ্চলের ঘটনাগুলোর প্রতিবেদন তৈরি করতেন। সে সময় তিনি প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই তিন থেকে চারজন ইসরায়েলি সাংবাদিকের ফোন পেতেন। তাঁদের তিনি সারা দিনের ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতেন। অনেক সময় আমরা টেলিফোনেই শুনতে পেতাম যে তাঁর স্ত্রী তাঁর চার বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছেন। এভাবে তিনি বছরের পর বছর পারিবারিক সন্ধ্যাটা ত্যাগ করেছেন শুধু আমাদের সহযোগিতা করতে।

অনেক সময় আমাদের পেশাগত সম্পর্ক রূপান্তরিত হতো সত্যিকারের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বে। আমরা তাঁদের ওপর নির্ভর করতাম খবর ও ঘটনাগুলো জানতে, তাঁরা আমাদের সহযোগিতার প্রত্যাশা করতেন ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে, ইসরায়েলি আমলাতন্ত্রের কাছে পৌঁছাতে, কিংবা শুধু ইসরায়েলি সমাজকে সম্যকভাবে বুঝতে। একটি ফিলিস্তিনি দৈনিকে আমার এক সহকর্মী মাঝেমধ্যেই আমাকে ফোন করে জটিল হিব্রু অভিব্যক্তির সহজ অর্থ জানতে চাইতেন।

আবার যখন ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ আমাদের সহকর্মী ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অযৌক্তিক ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করত, আমরা তার প্রতিবাদ জানাতাম। প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনকে (পিএলও) সমর্থন দেওয়ায় একবার পূর্ব জেরুজালেমের দৈনিক আল-শায়াব পত্রিকার সম্পাদক আকরাম হানিয়াকে বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত নেয় ইসরায়েল সরকার।

আমরা তখন এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি তুলে প্রচারণা চালাই। আর কোনো রকম সহিংসতায় যুক্ত থাকার অভিযোগ হানিয়ার বিরুদ্ধে ছিল না। তখন একাধিক ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা আমাকে বলেছিলেন যে তাঁর কাজকর্ম ভীষণভাবে রাজনৈতিক। সে সময় আমি ‘আমরা সবাই আকরাম হানিয়া’ নামে একটি নিবন্ধ লিখি হারেৎজ–এ।

এ ছাড়া তাঁর একটি ছোট গল্পও আরবি থেকে অনুবাদ করে হারেৎজ–এর সাহিত্য সাময়িকীতে ছেপেছিলাম। হানিয়াকে অবশ্য পূর্ব জেরুজালেম থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় পিএলওর অন্যতম প্রধান সমঝোতাকারীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

কোনো সন্দেহ নেই, এসব সাংবাদিকের সবাই দেশপ্রেমী ফিলিস্তিনি। তাঁরা তাঁদের জনগণের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে পেশাগতভাবে আমাদের মতো তাঁরাও সত্যের প্রতি অনুগত, ঘটনার প্রতি দায়বদ্ধ।

আমি জানি যে এগুলো অনেক আগের কথা। ৭ অক্টোবর (হামাসের ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামলা ও জিম্মি অপহরণ) এবং তার পর থেকে এত সব বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটেছে যে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের মধ্যে দূরত্ব অনেক বেড়ে গেছে। হ্যাঁ, একদা যেমন ছিল, তাঁদের মধ্যকার সম্পর্ক আর তেমন নেই।

গাজায় যেসব হাজার হাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনিকে ইসরায়েল হত্যা করেছে, তাদের কারোর চেয়ে ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের রক্ত অধিকতর লাল নয়। অনেক সাংবাদিকই তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের বা কাজের সময় নয়, বরং নিজ বাসায় পরিবারের সঙ্গে নিহত হয়েছেন। তারপরও তাঁরা আমাদের সহকর্মী, সাংবাদিক

কিন্তু যখন ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গত সোমবার পর্যন্ত ১৮৯ জন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক গাজায় নিহত হয়েছেন, তখন এটা প্রত্যাশা করা কি অযৌক্তিক, ইসরায়েলি সাংবাদিকেরা কিছু একটা করবেন? কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট তো এসব হত্যাকাণ্ডের বেশির ভাগই নথিবদ্ধ করেছে।

এটাও কি খুব বেশি প্রত্যাশা হয়ে যায় যে গাজার একটি তাঁবুতে যখন এ মাসের প্রথম দিকে তাঁদেরই পাঁচজন সহকর্মীকে ইসরায়েল সরকার হত্যা করেছে, তখন ইসরায়েলি সাংবাদিকেরা সোচ্চার হয়ে উঠবেন? এমনকি যদি সরকারি ভাষ্য অনুসারে এই পাঁচজনের একজন হামাসের সঙ্গে জড়িত থেকে থাকেন, তাহলেও?

ইসরায়েলে বেশ কয়েকটি সাংবাদিক সমিতি সক্রিয় আছে। এ মাসের প্রথম দিকে আনাস আল-শরিফ ও তাঁর আল–জাজিরার সহকর্মীকে হত্যার প্রতিবাদে কেউ একটি বিবৃতি পর্যন্ত দেয়নি। ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় এত সাংবাদিককে হত্যা করা হলো, মাত্র গুটিকয় এ বিষয়ে মুখ খুলেছে।

অথচ ইসরায়েলি গণমাধ্যম গাজার সাংবাদিকদের ওপর নির্ভর করে, খবর ও তথ্য সংগ্রহের জন্য তাঁদের ব্যবহার করে। তাহলে কি তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা বিবৃতি দেওয়া ছাড়া আর বেশি কিছু করতে পারে না?

খুব অল্প কয়েকজন ইসরায়েলি ও আন্তর্জাতিক সাংবাদিক গাজা উপত্যকায় যেতে পারেন এবং তা ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সঙ্গে। একমাত্র গাজার ফিলিস্তিনি সাংবাদিকেরাই এখন পর্যন্ত স্বাধীনভাবে সেখানে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁরা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ও জীবন বিসর্জন দিয়ে প্রকৃত তথ্য, ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করছেন। ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যম, যারা গাজার পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ ও প্রতিবেদন প্রকাশ করতে চায়, গাজার ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ছাড়া তারা অচল, অন্ধ।

উদ্বেগ প্রকাশ করা, কিছুটা সংহতি প্রদর্শন করা তো পেশাগত সহমর্মিতা বা খবর সংগ্রহের দায়বদ্ধতার চেয়ে বেশি কিছু। এটা তো মানবতার বিষয়।

গাজায় যেসব হাজার হাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনিকে ইসরায়েল হত্যা করেছে, তাদের কারোর চেয়ে ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের রক্ত অধিকতর লাল নয়। অনেক সাংবাদিকই তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের বা কাজের সময় নয়; বরং নিজ বাসায় পরিবারের সঙ্গে নিহত হয়েছেন। তারপরও তাঁরা আমাদের সহকর্মী, সাংবাদিক।

আর তাই গাজায় তাঁদের সহকর্মীদের উপেক্ষা করার মধ্য দিয়ে ইসরায়েলি সাংবাদিকেরা নৈতিক অবমাননায় আরেক ধাপ এগিয়ে গেলেন। বিগত ৬৯০ দিনের বেশি সময় ধরে গাজার বেসামরিক নাগরিকদের চরম দুর্দশাকে ঠিকমতো তুলে না ধরা বা পুরোপুরি উপেক্ষা করার মধ্য দিয়ে তাঁরা পেশাগত নৈতিকতার যে অবমাননা করে চলেছিলেন, এটা তা আরও বাড়িয়ে দিল।

অথচ ফিলিস্তিনিদের ক্রমাগত বিমানবিকীকরণে ইসরায়েলি জনগণের সঙ্গে তাল না মিলিয়ে ইসরায়েলের সাংবাদিকদের তো উচিত ছিল মানবতা ও সহমর্মিতার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনের। আপনি হয়তো বলবেন যে এটা তো এক হাস্যকর সারল্যে পূর্ণ এক প্রত্যাশা। তবে আমি এটা মনে করতে চাই যে ইসরায়েলের মূলধারার গণমাধ্যম এখনো এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশে সক্ষম।

ওরি নির যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে অবস্থানরত এক ইসরায়েলি সাংবাদিক। হারেৎজ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখা ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন আসজাদুল কিবরিয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Previous Story

যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ শতাংশ শুল্ক ভারতের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে, দুই দেশের সম্পর্কেও ফাটল দেখা দিচ্ছে।

Next Story

আমেরিকার কাছে শেষ দুর্গও কি হারাতে চলেছে ইরান?

Previous Story

যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ শতাংশ শুল্ক ভারতের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে, দুই দেশের সম্পর্কেও ফাটল দেখা দিচ্ছে।

Next Story

আমেরিকার কাছে শেষ দুর্গও কি হারাতে চলেছে ইরান?

Latest from Blog

আলি আমজদের ঘড়িঘর

সরোজ কান্তি দেওয়াঞ্জী , সিলেট শহরের কোর্ট পয়েন্টে, সুরমা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে এক পুরোনো সাক্ষী—আলি আমজদের ঘড়িঘর।যে ঘড়িঘর দিনের আলোয় সময় বলে, আর রাতে শহরের নিস্তব্ধতায় অতীতের গল্প শোনায়। বলা হয়,

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে

জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর ২০২৫ অনুষ্ঠানকে ঘিরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার (১৫ অক্টোবর) বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে এ বৈঠক

কিছু উপদেষ্টা ষড়যন্ত্রে জড়িত, তাদের কণ্ঠ রেকর্ডসহ প্রমাণ রয়েছে: তাহের

অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা প্রশাসনে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর অনুগতদের বসিয়ে ‘পরিকল্পিত নির্বাচন’ আয়োজনের ষড়যন্ত্র করছেন বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি দাবি করেছেন, এ ষড়যন্ত্রে

শাপলার পরিবর্তে নতুন প্রতীক নির্বাচনে এনসিপিকে সময়সীমা নির্ধারণ করল ইসি

জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) শাপলা প্রতীক দেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ। তিনি বলেন, আগামী ১৯ অক্টোবরের মধ্যে দলটিকে শাপলার বিকল্প প্রতীক বেছে নিতে হবে। মঙ্গলবার

ঝটিকা মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককে দেওয়া হচ্ছে ৫ হাজার টাকা

আওয়ামী লীগের কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ রয়েছে, আর সেই অর্থ ব্যবহার করে তারা আসন্ন নির্বাচনকে ভণ্ডুল করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত দলের সদস্যদের ঝটিকা মিছিলে অংশ নিতে প্রলুব্ধ করতে
Go toTop

Don't Miss

আলি আমজদের ঘড়িঘর

সরোজ কান্তি দেওয়াঞ্জী , সিলেট শহরের কোর্ট পয়েন্টে, সুরমা নদীর

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে

জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর ২০২৫ অনুষ্ঠানকে ঘিরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের