প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত দুটি দাবি—জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও ভোটাধিকার—অবশেষে বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে। অতীতে বিভিন্ন সরকার নিজেদের প্রবাসীবান্ধব বলে দাবি করলেও এই মৌলিক অধিকার থেকে প্রবাসীরা ছিলেন বঞ্চিত। তবে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই স্বপ্নপূরণের পথে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যেই এনআইডি ও ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরাও এই সুবিধা পাচ্ছেন। নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল ও ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে আনুষ্ঠানিকভাবে এই কর্মসূচির উদ্বোধন করা হয়েছে।
তবে ভোটার হওয়ার সুযোগ মিললেও, বর্তমান নাগরিকত্ব আইন বহাল থাকলে অনেক প্রবাসী এখনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। বিশেষ করে যারা বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন, তারা বিদ্যমান আইনে অযোগ্য। ফলে এ ধারাটি পুনর্বিবেচনার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
এনআইডি কার্যক্রম শুরু হওয়ায় প্রবাসীদের মধ্যে বইছে খুশির জোয়ার। তবে তারা অভিযোগ করেছেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। অনেকের বাবা-মা প্রয়াত বা তাদের জন্মসনদ ও পাসপোর্ট নেই—ফলে তথ্য প্রমাণ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। প্রবাসীরা চান, জন্মসনদ থাকলেই যেন এনআইডি পাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।
নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী, এনআইডির জন্য অনলাইনে ফরম পূরণ, অনলাইন যাচাইকৃত জন্মসনদ, বাংলাদেশি বা বিদেশি পাসপোর্টের কপি, পিতা-মাতার এনআইডি বা অনলাইন ভেরিফাইড জন্ম/মৃত্যু সনদ, নাগরিকত্ব বা ওয়ারিশ সনদের কপি এবং পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। অন্যান্য কাগজপত্র ঐচ্ছিক হলেও, না জমা দিলে এনআইডি প্রাপ্তিতে বিলম্ব হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
নড়াইল-২ আসন থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য আলহাজ লতিফ সম্রাট বলেন, “৫৩ বছরের ইতিহাসে যা কোনো রাজনৈতিক সরকার পারেনি, অন্তর্বর্তী সরকার তা করে দেখিয়েছে—এটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।” তিনি আরও বলেন, “বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণকারী প্রবাসীদেরও নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকা প্রবাসীদের জন্য এই আইনের ধারা শিথিল করা সময়ের দাবি।”
অন্তর্বর্তী সরকারের এই পদক্ষেপের ফলে এখন থেকে প্রবাসীরা নিজ নিজ কনস্যুলেট থেকেই সরাসরি এনআইডি ও ভোটার নিবন্ধন সংক্রান্ত সেবা নিতে পারবেন। এতে তারা দেশের বিভিন্ন সরকারি সেবা ও কার্যক্রমে আরও সহজে অংশ নিতে পারবেন। অনেক প্রবাসী একে “দীর্ঘদিনের দাবির বাস্তবায়ন” বলে উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ কনুস্যলেট: গত ৩ অক্টোবর শুক্রবার নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনুস্যলেটে এনআইডি’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র সফররত নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল মো. মোজাম্মেল হক। এসময় বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে এ উদ্যোগকে স্বাগত জানান।
অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ সমবেতদের উদ্দেশ্যে বলেন, এ কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি সরকারের অঙ্গীকার প্রতিফলিত হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আরো জানান, বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী এবং আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী ১৮ বছরের অধিক বয়সী (২০০৮ সালের ১ জানুয়ারির আগে জন্মগ্রহণকারি) সন্তানেরাও পাবেন এনআইডি (ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ড)। আবেদনের সময় জন্মগত সার্টিফিকেটের (১৭ ডিজিট ক্রমিকের) কপি অথবা নম্বর এবং বাংলাদেশি পাসপোর্টের কপি। এই পাসপোর্টের নাম, জন্ম তারিখ এবং বার্থ সার্টিফিকেটের নাম ও জন্মতারিখে গড়মিল হলে চলবে না। ইতিমধ্যেই যারা বাংলাদেশে আবেদন করেছেন তারা এখান থেকে আর কোনো সুযোগ পাবেন না অর্থাৎ তাদেরকে নতুন করে আবেদনের প্রয়োজন নেই। কারণ, নিউইয়র্ক থেকে শুধুমাত্র নতুন এনআইডি কার্ড ইস্যু করা হবে।
প্রবাসে থেকে প্রাপ্ত এনআইডি কার্ডধারীরা ভোটের সময় বাংলাদেশে থাকলেও ভোট দিতে পারবেন না কিংবা নির্বাচনে প্রার্থী হবার সুযোগও পাবেন না বলে জানান আখতার আহমেদ। তারা শুধুমাত্র ডাকযোগে ভোট দিতে পারবেন।
কনসাল জেনারেল মোজাম্মেল হক তার বক্তব্যে এই সেবা প্রদানে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তাছাড়া কমিউনিটির নেতাদের প্রতি নতুন সেবা সম্পর্কে প্রবাসীদের অবহিত করার আহ্বান জানান তিনি।
প্রবাসীরা এখন অনলাইন পোর্টালের (https://services.nidw.gov.bd) মাধ্যমে আবেদন করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও বায়োমেট্রিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারবেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সোসাইটির ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ, সভাপতি আতাউর রহমান সেলিম, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা আব্দুল লতিফ সম্রাট, জিল্লুর রহমান জিল্লু, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারি (পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি) কমিটির সদস্য গোলাম ফারুক শাহীন, সন্দ্বীপ সোসাইটির সভাপতি ও ফোবানা সেক্রেটারি ফিরোজ আহমেদ, সাবেক চট্টগ্রাম সমিতির সভাপতি কাজী আজম, বাংলাদেশ সোসাইটির সহ-সভাপতি কামরুজ্জামান কামরুল, বিএনপি নেতা আনওয়ারুল ইসলাম আনোয়ার, বিএনপি নেতা এম এ সবুর, যুক্তরাষ্ট্র শ্রমিক দলের নেতা জাহাঙ্গির আলম, স্টেট বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহবায়ক আনিসুর রহমান, দেওয়ান কাউসার, ব্যবসায়ী মো. কামরুল ইসলাম সনি প্রমুখ।
বিএনপি, বাংলাদেশ সোসাইটি ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা প্রবাসীদের ভোটাধিকার বাস্তবায়নে এ উদ্যোগকে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসীদের দেশে নিজেদের সম্পদ সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া সহজ হবে। এছাড়াও প্রবাসীরা ভবিষ্যতে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেয়ার ক্ষেত্রেও এই পরিচয়পত্র সহায়ক হবে।
বাংলাদেশ দূতাবাস : ওয়াশিংটন ডিসির বাংলাদেশ দূতাবাসে এনআইডি কার্ড প্রদানের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে গত ৫ অক্টোবর রোববার। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ। আরো উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রদূত তারেক মো. আরিফুল ইসলাম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টর জেনারেল এটিএম আবদুর রউফ মন্ডল। অনুষ্ঠানে দূতাবাসের কর্মকর্তা ও ওয়াশিংটন ডিসির বাংলাদেশ কমিউনিটির অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদ প্রবাসীদের সহজ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এনআইডি কার্ড প্রদান করা হবে বলে জানান। যার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মত প্রবাসীরা ভোট প্রদান করতে পারবেন। এ সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় ওয়েবসাইটে প্রদান করা হবে।
উল্লেখ্য নিউইয়র্ক, মিয়ামি ও লসঅ্যাঞ্জেলসের বাংলাদেশ কনস্যুলেটেও এনআইডি কার্ড প্রদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে।