Dark
Light
Today: October 15, 2025
October 9, 2025
8 mins read

দেবদাসের মৃত্যু কাহিনী (বিস্তারিত গল্প)

সরোজ কান্তি দেওয়াঞ্জী ,

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দেবদাস এক অমর চরিত্র—ভালোবাসা, বেদনা ও আত্মবিধ্বংসের প্রতীক। তার জীবন শুরু হয়েছিল এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে, কিন্তু শেষ হয়েছিল এক করুণ ও নিঃসঙ্গ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

শৈশব ও প্রেমের শুরু

দেবদাস ছিল বঙ্গদেশের তৎকালীন বর্ধমান জেলার তালসোনাপুর গ্রামের জমিদার নারায়ণ মুখার্জির ছেলে। পাশের জমিদার পরিবারের মেয়ে পার্বতী (পারো) তার শৈশবসঙ্গিনী। ছোটবেলা থেকেই দুজনের মধ্যে ছিল গভীর স্নেহ, হাসি-ঠাট্টা আর এক মধুর বন্ধন, যা পরে রূপ নেয় প্রেমে।

কিন্তু সামাজিক মর্যাদা, পরিবারের অহংকার এবং ধর্মীয় ভেদাভেদ এই ভালোবাসার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দেবদাসের বাবা চাননি তার ছেলে কোনো নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করুক। অপরদিকে পারো’র পরিবারও অপমান সহ্য করতে না পেরে দ্রুত তার বিয়ে ঠিক করে দেন এক ধনী, বয়সে বড় জমিদারের সঙ্গে—ভবানীপুর গ্রামের বিধবা জমিদার ব্রজবন বাবুর সঙ্গে।

বিচ্ছেদ ও আত্মবিনাশ

এই বিচ্ছেদ দেবদাসকে ভেতর থেকে ভেঙে দেয়। সে কলকাতায় চলে আসে এবং মদের নেশায় ডুবে যায়।
ওখানেই তার দেখা হয় এক গণিকা চন্দ্রমুখীর সঙ্গে। কিন্তু চন্দ্রমুখীর ভালোবাসা সত্ত্বেও দেবদাস তার অতীতের প্রেম ভুলতে পারে না। প্রতিদিন মদ খেতে খেতে তার দেহ ও মন ভেঙে পড়তে থাকে।

চন্দ্রমুখী তার যত্ন করে, কিন্তু দেবদাস মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে নিজের হাতে।

শেষ যাত্রা

এক রাতে সে সিদ্ধান্ত নেয়—

“মরে যাব, কিন্তু তার আগে একবার পারোকে দেখে যাব।”

তার দুর্বল শরীর নিয়েই সে রেলগাড়িতে ওঠে, গন্তব্য — মনোহরপুর গ্রাম, পারো’র শ্বশুরবাড়ি।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, একেবারে ভোররাতে সে পৌঁছে যায় পারোদের গ্রামের কাছে। তখন শরৎকাল, হালকা কুয়াশায় ঢেকে আছে মাঠ। দেবদাসের হাতে তখনও ছিল ছোট্ট এক অ্যালুমিনিয়ামের পানির বোতল, যার ভেতরে একটু মদ অবশিষ্ট।

মৃত্যুর দৃশ্য

রাত শেষ হওয়ার আগে, ক্লান্ত ও অসুস্থ দেবদাস টলতে টলতে গিয়ে পৌঁছায় পারো’র বাড়ির সামনের বটগাছের নিচে। তার মুখ শুকনো, ঠোঁট ফেটে গেছে, চোখে শুধু একটিই আকাঙ্ক্ষা—পারোকে একবার দেখা।
কিন্তু তার আর শক্তি নেই কারো নাম ডাকারও। সে মাটিতে বসে পড়ে, তারপর ধীরে ধীরে শুয়ে যায়।

রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে আসে ভোর। ভোরবেলা গ্রামের লোকজন দেখতে পায়, পার্বতীর বাড়ির সামনে এক অচেনা লোক মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়ে আছে। খবর ছড়িয়ে যায়—

“একজন লোক মরেছে বড়বউঠানের দরজার সামনে!”

পার্বতী খবর পেয়ে দৌড়ে আসে জানালার পাশে। কিন্তু তখন সমাজের নিয়ম তাকে বাইরে যেতে দেয় না। জানালার ফাঁক দিয়ে সে চেয়ে দেখে—
মাটির ওপর শুয়ে আছে দেবদাস, তার মুখে এক শান্ত হাসি, ঠোঁটে শেষ নিঃশ্বাস থেমে আছে যেন পারোর নামেই।

শেষ নিঃশ্বাস

ঠিক ভোর ৫টার দিকে, মনোহরপুর গ্রামের পারো’র বাড়ির দরজার সামনে, দেবদাস শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
তার মৃতদেহের পাশে পড়ে ছিল ফাঁকা মদের বোতল আর এক পুরোনো রুমাল, যেখানে পারো’র নাম লেখা ছিল।

লোকেরা জানত না সে কে, শুধু নাম জানতে পেরেছিল — “দেবদাস মুখার্জি”।
গ্রামের লোকেরা তাকে নদীর ঘাটে দাহ করে, আর পারো জানালার আড়াল থেকে নীরবে কাঁদে।

শেষ উপলব্ধি

দেবদাসের মৃত্যু ছিল এক দহন, যা সমাজ, অহংকার, ও নিজের দুর্বলতার ফল।
সে মরেছিল ভালোবাসার জন্য — সেই ভালোবাসা, যা কখনও পূর্ণ হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Previous Story

খালেদা জিয়া জিয়াউর রহমানের মাজারে দোয়া করলেন

Next Story

আমির হামজার বক্তব্য প্রসঙ্গে মুখ খুললেন তাহেরি

Previous Story

খালেদা জিয়া জিয়াউর রহমানের মাজারে দোয়া করলেন

Next Story

আমির হামজার বক্তব্য প্রসঙ্গে মুখ খুললেন তাহেরি

Latest from Blog

আলি আমজদের ঘড়িঘর

সরোজ কান্তি দেওয়াঞ্জী , সিলেট শহরের কোর্ট পয়েন্টে, সুরমা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে এক পুরোনো সাক্ষী—আলি আমজদের ঘড়িঘর।যে ঘড়িঘর দিনের আলোয় সময় বলে, আর রাতে শহরের নিস্তব্ধতায় অতীতের গল্প শোনায়। বলা হয়,

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে

জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর ২০২৫ অনুষ্ঠানকে ঘিরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার (১৫ অক্টোবর) বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে এ বৈঠক

কিছু উপদেষ্টা ষড়যন্ত্রে জড়িত, তাদের কণ্ঠ রেকর্ডসহ প্রমাণ রয়েছে: তাহের

অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা প্রশাসনে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর অনুগতদের বসিয়ে ‘পরিকল্পিত নির্বাচন’ আয়োজনের ষড়যন্ত্র করছেন বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি দাবি করেছেন, এ ষড়যন্ত্রে

শাপলার পরিবর্তে নতুন প্রতীক নির্বাচনে এনসিপিকে সময়সীমা নির্ধারণ করল ইসি

জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) শাপলা প্রতীক দেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ। তিনি বলেন, আগামী ১৯ অক্টোবরের মধ্যে দলটিকে শাপলার বিকল্প প্রতীক বেছে নিতে হবে। মঙ্গলবার

ঝটিকা মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককে দেওয়া হচ্ছে ৫ হাজার টাকা

আওয়ামী লীগের কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ রয়েছে, আর সেই অর্থ ব্যবহার করে তারা আসন্ন নির্বাচনকে ভণ্ডুল করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত দলের সদস্যদের ঝটিকা মিছিলে অংশ নিতে প্রলুব্ধ করতে
Go toTop

Don't Miss

আলি আমজদের ঘড়িঘর

সরোজ কান্তি দেওয়াঞ্জী , সিলেট শহরের কোর্ট পয়েন্টে, সুরমা নদীর

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে

জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর ২০২৫ অনুষ্ঠানকে ঘিরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের