যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাস ও জাতিসংঘ স্থায়ী মিশনের গোপন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রাজনৈতিক তাণ্ডব সৃষ্টির মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সফরসঙ্গীদের হেনস্তা করার অভিযোগ উঠেছে। জাতিসংঘে ১০৪ সদস্যের বড়সড় লটবহরে রয়েছেন ড. ইউনূসের দুই কন্যা, আসিফ নজরুলসহ ছয়জন উপদেষ্টা, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ২১ জন সেনা কর্মকর্তা, বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক, প্রেস উইংয়ের পাঁচ সদস্যসহ আরও অনেকে।
এদিকে নিউইয়র্কে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক তাণ্ডবও চলছে তুঙ্গে। বিএনপি ও এনসিপি নেতাদের শাসক দলের কর্মীদের হাতে তুলে দেওয়ায় দূতাবাসের অভ্যন্তরে কর্মরত কিছু কর্মকর্তা বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছেন। সম্প্রতি কনস্যুলেটে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর হামলার ঘটনায় সৃষ্ট উত্তেজনা কাটতে না কাটতেই নতুন করে এই সহিংসতা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের এমন ভূমিকা ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অসহায় অবস্থাকেই ফুটিয়ে তুলছে। সরকারের ভেতরেই যেন আরেকটি সমান্তরাল প্রশাসন কাজ করছে—যা বিগত স্বৈর সরকারের মতো আচরণ করছে বলে অনেকে অভিযোগ তুলছেন। স্থায়ী মিশনের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “তাদের দাপটে স্বাভাবিক কাজ করা কঠিন, আগের মতোই তারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখছে।”
এবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে শফিকুল আলম, ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ, অপূর্ব জাহাঙ্গির, সি. অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ফয়েজ আহাম্মদ ও অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রেস সেক্রেটারি সুশমিতা তিথি ছাড়াও পিআইডির নয়জন কর্মকর্তা সফরে এসেছেন। এমনকি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ক্যান্সার আক্রান্ত এক নারী উপদেষ্টাও এবার জাতিসংঘ সফরে অংশ নিয়েছেন।
তবে জানা গেছে, ড. ইউনূসের বিশাল এই প্রতিনিধি দলের অনেকেই সরকারি কাজের চেয়ে ব্যক্তিগত ব্যস্ততাতেই সময় কাটাচ্ছেন।
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের নতুন রাষ্ট্রদূত তারেক মো: আরিফুল ইসলাম এবং নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ি প্রতিনিধি সালাহউদ্দিন নোমান চৌধুরীর নিয়োগের পরই মিশনের গোপন পরিকল্পনা শুরু হয় বলে সূত্র জানিয়েছে। তাদের পরিকল্পনায় সাজানো হয় ড. ইউনূস ও তাঁর সফরসঙ্গিদের জন্য ‘চৌকুস প্রটোকল টিম’। এই পরিকল্পনার সাথে আরও শীর্ষ প্রভাবশালীরা জড়িত থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এজন্য নেপাল বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে একজন কর্মকর্তা মো: শোয়েব আবদুল্লাহকে হায়ার করে নিউইয়র্কে নিয়ে আসা হয়। মিশনে তাদের কয়েকদিন মিটিংও হয়েছে। ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ ক্যাডার হিসেবে শোয়েবের নিয়োগ আর এবার ড. ইউনূস ও তাঁর সফরসঙ্গীদের হেনস্থা করতে তাকে নিউইয়র্কে আনা হয় বলে অভিযোগ। জাতিসংঘে ড. ইউনূসের সফর সঙ্গীদের যে তালিকা রয়েছে তাতে দেখা যায় ‘৮৮ নম্বরে’ আছে শোয়েবের নাম। নেপাল বাংলাদেশ দূতাবাসের ওয়েব সাইটে দেখা যায়, শোয়েব আবদুল্লাহ নেপাল বাংলাদেশ দূতাবাসের ‘ডেপুটি চিফ’ হিসেবে কর্মরত। আরেকটি সূত্র জানায়, তাকে নেপালে বদলি করা হলেও খুটির জোরে নিউইয়র্কেই তিনি অবস্থান করছেন। ফোন করে শোয়েব আবদুল্লাকে পাওয়া যায়নি। শোয়েব আবদুল্লাহ জাতিসংঘ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান সালাহউদ্দিন নোমান চৌধুরীর রাজনৈতিক শিষ্য ও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে হেনস্থার কাজে তাকে হায়ার করার অভিযোগ উঠেছে। দূতাবাস, স্থায়ি মিশন ও কনস্যুলেটের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে প্রটোকল টিম না সাজিয়ে নেপাল থেকে মো: শোয়েব আবদুল্লাহকে নিয়ে আসার পেছনের ঘটনা ফাঁস হতে শুরু করে। প্রথমে রাজনৈতিক নেতাদের চলে যাওয়ার একটা ভুল তথ্য ছড়ানো হয় বিমানবন্দরে। তাদের কথামতো বিএনপির সমর্থকরা ৪ নম্বর টার্মিনাল থেকে চলে যায়। তবে আওয়ামী লীগ কর্মীদের সেখানে থাকার জন্য ভেতর থেকে বলা হয়। এর কিছুক্ষণ পরই ঘটে শোয়েব আবদুল্লাহ ও তার সহকর্মীদের ন্যাক্কারজনক আসল ঘটনা। ২২ সেপ্টেম্বর জেএফকে বিমানবন্দর। ৪ নম্বর টার্মিনালে শোয়েবই প্রথম বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে হাত ধরে টানাটানি শুরু করেন। তাঁকে শোয়েব যেভাবে টানছিলেন তা ছিল সকল কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত এক নোংরা দৃশ্য। বিএনপি নেতা ফখরুল ইসলাম বারবার শোয়েবের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চান। তবে শোয়েব জোর করে তাঁকে আসামির মতো হাত ধরে টানতেই থাকেন। তার টানাটানির দৃশ্য মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়। বিএনপি মহাসচিবকে টেনে বাইরে বের করার পথেই অপেক্ষমান ছিল যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা। ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পেছনে তাকে অনুসরণরত ছিলেন এনসিপির নেতা আখতার হোসেন ও ডা. তাসনিম জারা। জামাত নেতা আব্দুল্লাহ মো: তাহের পেছনে থেকে সব দেখে নিউইয়র্কের সমর্থকদের ফোন করেন। তারা এগিয়ে আসলে তিনি সবাইকে নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে বের হয়ে যান। এদিকে ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আখতার এবং ডা. জারাকে অতি নিকটে এবং একা পেয়ে ভয়াবহ এক রাজনৈতিক তান্ডব চালিয়ে যেতে থাকে আওয়ামী সমর্থকরা। খুব কাছে গিয়ে মিজান নামের এক কর্মী আখতারকে ডিম মারতে থাকে। ডা. জারাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়েছে আওয়ামী লীগ কর্মীরা। এই দৃশ্য সকালেই দুনিয়াব্যাপি ছড়িয়ে যায়। বাংলাদেশের মানুষ রাতেই বিমানবন্দরে তান্ডবের এই দৃশ্য দেখে হতবাক হয়েছেন। অন্যদিকে ড. ইউনূস বিশেষ প্রটোকল নিয়ে ম্যানহাটনের গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে উঠে যাবার পর ঘটনা জানতে পারেন। তবে তাঁর মিশনের কোন কর্মকর্তারা সহযোগিতায় এগিয়ে আসেননি বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগিরা।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের দুই রাষ্ট্রদূতের নিয়োগের পেছনে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন ইউনূস সরকারের বিতর্কিত পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। জানা গেছে, জেএফকে বিমানবন্দরে অ্যামিরাত এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট সবসময় ৪ নম্বর টার্মিনালেই নামে। তবুও ২২ সেপ্টেম্বর প্রটোকল কর্মকর্তাদের কৌশলের কারণে ড. ইউনূসের সফরসঙ্গীরা হয়রানির শিকার হন। এর আগেই আওয়ামী লীগ খোলাখুলিভাবে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে হামলার ইঙ্গিত দিয়েছিল এবং তাঁর সফরসঙ্গীদেরও টার্গেট করা হয়। মিশন কর্মকর্তারা নীরব থাকায় হামলাকারীরা বিদেশে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
এর আগে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা বিমানবন্দরে আওয়ামী কর্মীরা হয়রানি করেছিল। অভিযোগ রয়েছে, সে হামলার পেছনে উস্কানি দিয়েছিলেন বর্তমান ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তারেক মো. আরিফুল ইসলাম। তিনি তখন সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের প্রধান ছিলেন। আরও জানা গেছে, ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালে দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে দায়িত্ব পালনকালে তিনি এই নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। বর্তমান মিশন প্রধান সালাহউদ্দিন নোমান চৌধুরী এবং তারেক মো. আরিফুল ইসলাম—দুজনেই ১৯৯৮ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন এবং ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সুবাদে তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন।
এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত খবর পাওয়া গেছে, নিউইয়র্কের গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের বৈঠকের আয়োজন করা হচ্ছে, যেখানে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সমঝোতার চেষ্টা হতে পারে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা প্রতিদিন ড. ইউনূসের হোটেলের বাইরে বিক্ষোভ করছে।