গাজা সিটিতে মঙ্গলবার থেকে নতুন করে স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল। মাত্র একদিনেই প্রাণ হারিয়েছেন ৭০ জনেরও বেশি মানুষ। এমন পরিস্থিতিতেও নিজেকে শান্তির দূত দাবি করা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নীরব রয়েছেন। অনেকের মতে, তাঁর এই নীরবতাকেই নেতানিয়াহু প্রশাসন সবুজ সংকেত হিসেবে দেখছে।
ইসরায়েলের অভিযান শুরুর ঘোষণার সময় ট্রাম্প তেল আবিবকে সংযমের আহ্বান জানাননি, আবার প্রকাশ্যে সমর্থনও দেননি। নেতানিয়াহুর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে এই অবস্থানকে অনেক বিশ্লেষক ‘ল্যাসে-ফেয়ার’ নীতি বলছেন—যার অর্থ কাউকে যা করতে চায় তা করতে দেওয়া। গাজা ইস্যুতেও ট্রাম্প যেন একই নীতি অনুসরণ করছেন—যা হওয়ার হবে।
এর আগে বিশ্বের বড় কয়েকটি দেশ সতর্ক করেছিল, নতুন অভিযান বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বাড়াবে এবং যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হবে। তবুও ট্রাম্প তখনও নীরব দর্শক হয়েই রইলেন। মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসের বাইরে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি জানান, গাজা অভিযান নিয়ে তিনি এখনো ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে কোনো আলোচনা করেননি।
ট্রাম্পকে যখন সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেন, তিনি আক্রমণকে সমর্থন করেন কিনা, তখন প্রেসিডেন্টের উত্তর ছিল, ‘আচ্ছা, আমাকে দেখতে হবে। আমি এ বিষয়ে খুব বেশি জানি না।’
সবুজ সংকেত
নিজেকে বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তুলে ধরে, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায় দুই বছর ধরে চলা গাজা যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আসছেন। আগে তিনি ইসরায়েলকে প্রকাশ্যে সংঘাত বন্ধের চাপ দিতেন। তবে এখন সংঘাত বাড়তে থাকলেও তিনি তা নির্লিপ্তভাবে দেখে যাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সামরিক সহায়তা ইসরায়েলকে সংঘাত চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কেবল একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টই পারেন নেতানিয়াহুর দৌঁড়ে লাগাম টানতে। কিন্তু ট্রাম্প তা না করায় নেতানিয়াহু লাগামহীন ঘোড়ার মতো ছুটছেন।
জর্জ ডব্লিউ বুশের সময় ইসরায়েলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন ড্যানিয়েল সি কার্টজার। তিনি বলছেন, ‘ট্রাম্প স্পষ্টতই যুদ্ধের অবসান ও জিম্মিদের মুক্তি চান। কিন্তু তাঁর কাছে নেতানিয়াহুকে চাপ দেওয়ার কোনো কৌশল নেই। তিনি হামাসকে হুমকি দেন, আর নেতানিয়াহু সেটিকে সবুজ সংকেত হিসেবে ধরে নেন।’
ড্যানিয়েল কার্টজার আরও বলেন, যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য একমাত্র ট্রাম্পই এখন ভূমিকা রাখতে পারেন। কিন্তু এ জন্য তাঁকে শুধু কথা না বলে কাজ করতে হবে।
চলতি বছর এক ইসরায়েলি সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘আপনাকে যুদ্ধ শেষ করতেই হবে।’
সে সময় মনে হয়েছিল তিনি নেতানিয়াহুর ওপর চাপ তৈরি করছেন। কিন্তু গাজায় ইসরায়েলের অভিযান যখন বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ বাড়িয়ে তুলেছে, তখন ট্রাম্প নীরব। বরং তিনি এখন হামাসের সঙ্গে সমঝোতা হবে কি না, তা নিয়েই কথা বলছেন। গত জুলাইয়ে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, ‘আমার মনে হয় তারা (হামাস) মরতেই চায়।’
পশ্চিমা নেতারা যখন গত মাসে সতর্ক করে বলেছিলেন যে ইসরায়েল হয়তো পুরো গাজা দখল করতে পারে, তখনও ট্রাম্প বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে শুধু বলেছিলেন, ‘এটা ইসরায়েলের ওপরই নির্ভর করছে।’
ওবামা ও বাইডেন প্রশাসনের সাবেক মধ্যপ্রাচ্য নীতি বিশেষজ্ঞ ইলান গোল্ডেনবার্গের মতে, প্রথমদিকে মনে হয়েছিল ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির জন্য চেষ্টা করবেন এবং নিজের প্রভাব ব্যবহার করে সংঘাত থামাবেন। কিন্তু তা হয়নি। বরং প্রতিটি ধাপে তিনি নেতানিয়াহুকে কার্যত খালি চেক দিয়ে গেছেন।
এখনই নেতানিয়াহুর ওপর চাপ তৈরি করার সময়।
ইসরায়েল নিয়ে ট্রাম্পের ‘ল্যাসে-ফেয়ার’ মনোভাব শিগগিরই নতুন পরীক্ষার মুখে পড়তে পারে। আগামী সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত হবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশন। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ মিত্র- যেমন ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাজ্য ফিলিস্তিনিকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেবে।
যদিও এমন পদক্ষেপ মূলত প্রতীকী, তবে তা ইসরায়েলকে বেশ ক্ষুব্ধ করছে। দেশটির ডানপন্থী নেতারা হুমকি দিচ্ছেন যে তারা পশ্চিম তীরের কিছু অংশ দখল করে নেবেন। এই দখল প্রক্রিয়াই ইসরায়েলের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আরব প্রতিবেশীদের সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হতে পারে।
কারণ, ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে একটি চুক্তির মধ্যস্থতা করেছিলেন। যেটি ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ নামে পরিচিত। চুক্তি করা দেশগুলো হলো- সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদান। এই চুক্তির প্রতিশ্রুতি ছিল ইসরায়েল পশ্চিম তীরের একটি অংশ দখল করবে না। এই চুক্তিতে সৌদি আরবকেও যুক্ত করার কথা ছিল।
এখন ইসরায়েল যদি পশ্চিম তীরের বড় অংশ বা পুরোটা দখল করে নেয়, তাহলে ওই চুক্তি লঙ্ঘন হবে। পাশাপাশি সৌদি আরবের সঙ্গেও ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না। এ বিষয়টিই হয়তো শিগগিরই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য করতে পারে। সেটি হলো- নেতানিয়াহুর ওপর চাপ দেওয়ার সময় এসে গেছে।