চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে অংশ নিতে ১০টি প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে। তবে সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ৯টি প্যানেলই কোনো নারী প্রার্থী দেয়নি। কেবল একটি প্যানেল জিএস পদে একজন ছাত্রীকে মনোনয়ন দিয়েছে।
শীর্ষ পদে নারী প্রার্থী না দেওয়ার ব্যাখ্যায় অধিকাংশ প্যানেল বলছে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন, জয়ের সম্ভাবনা কম এবং সাংগঠনিক ঘাটতি আছে। কিন্তু ছাত্রীরা মনে করেন, আসল কারণ হলো রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব এবং নারীদের ইচ্ছাকৃতভাবে পিছিয়ে রাখার প্রবণতা।
একমাত্র নারী প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী জোট’। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় থাকা শিক্ষার্থী সংগঠন স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি (স্যাড) ও ছাত্র ফেডারেশনের সমন্বয়ে গঠিত এ জোট থেকে জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন পদার্থবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী তাসনীম জাহান শ্রাবণ।
তাসনীম জাহান বলেন, ‘নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নিরাপদ নয়। এখানে ছাত্রীদের নিয়মিত বুলিং, শেমিং ও মোরাল পুলিশিংয়ের মতো ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। অনলাইন ও সরাসরি—দুই ক্ষেত্রেই ছাত্রীরা এসব ঘটনার শিকার হন। তাই অনেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হতে চান না।’
আগামী ১২ অক্টোবর সপ্তম চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। চাকসুর মোট ২৮ পদের মধ্যে নির্বাচিত হবেন ২৬ জন। পদাধিকারবলে সভাপতি থাকবেন উপাচার্য। আর কোষাধ্যক্ষ পদে সভাপতিই একজন শিক্ষককে মনোনীত করবেন।
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর ভোট হচ্ছে এ সংসদে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিভিন্ন আন্দোলনে সামনে থাকা ছাত্রীরা শীর্ষ পদে প্রার্থী না হওয়ায় বিস্ময় তৈরি হয়েছে। চাকসু নিয়ে আশা-আকাঙ্ক্ষা সব সময়ই বেশি। সংগঠনগুলো যদি নারী প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দিত, তবে নির্বাচনী প্রচারণায় নতুন সুর শোনা যেত। এখন আলোচনায় নারী প্রার্থীর সংখ্যা নয়, বরং তাঁদের অনুপস্থিতিই বেশি আলোচিত হচ্ছে। নির্বাচনে অংশ নেওয়া ১০টি প্যানেলের মধ্যে ২৬০ পদের মধ্যে নারী প্রার্থী আছেন ৩৭ জন।
মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া নাসরিন বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম অন্তত দুই–তিনটি প্যানেলে ভিপি বা জিএস পদে নারী প্রার্থী থাকবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেবল একটি প্যানেলেই রাখা হয়েছে। বিষয়টি হতাশাজনক।’
শীর্ষ পদে নারী না থাকার প্রসঙ্গে বড় ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলো। ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মোহাম্মদ আলী জানান, ‘আমরা নারীদের এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। সে কারণে সম্পাদক পদে দুজন ছাত্রীকে রাখা হয়েছে। তবে ভিপি ও জিএস পদে যাঁদের মনোনীত করা হয়েছে, তাঁদের আমরা বেশি যোগ্য মনে করেছি।’
অন্যদিকে ছাত্রদলের সভাপতি আলাউদ্দিন মহসিন স্বীকার করেন তাঁদের সীমাবদ্ধতার কথা। তিনি বলেন, ‘প্রায় এক দশক ধরে ক্যাম্পাসে ছাত্রদল সক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারেনি। ৫ আগস্টের পরও রাজনীতি চর্চায় বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। আসলে শীর্ষ এক পদে একজন ছাত্রীকে মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি।’
সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে শীর্ষ পদে কোনো ছাত্রী রাখা সম্ভব হয়নি বলে জানান দ্রোহ পর্ষদের ভিপি প্রার্থী ঋজু লক্ষ্মী অবরোধ। তিনি জানান, সাংগঠনিকভাবে তাঁরা দুর্বল অবস্থায় আছেন। সংগঠনের বর্তমান আহ্বায়ক ইসরাত হক সম্প্রতি পড়াশোনা শেষ করেছেন। এ কারণে তিনি নির্বাচন করতে পারেননি।
নারীদের শীর্ষ পদে নির্বাচন করতে উৎসাহ দেওয়া দরকার ছিল বলে মনে করেন নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোশরেকা অদিতি হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ক্যাম্পাসে বিগত সময়ে নারীদের ওপর নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি প্রশাসনের কেউ কেউ নারীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। এসব করা হয়েছে মূলত নারীদের মনে ভীতির সঞ্চার করতে। এ জন্য শীর্ষ পদে নির্বাচন করার জন্য নারীদের উৎসাহ দিয়ে এগিয়ে আনা দরকার ছিল।