Dark
Light
Today: October 15, 2025
September 5, 2025
19 mins read

আমেরিকার কাছে শেষ দুর্গও কি হারাতে চলেছে ইরান?

গত দুই বছরে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের মিত্র নেটওয়ার্ক বড় ধরনের ধাক্কার মুখে পড়েছে। সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকার পতিত হয়েছে। লেবাননে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হিজবুল্লাহ অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হয়েছে। এখন সংগঠনটি অস্ত্র সমর্পণের চাপের সম্মুখীন।

ইয়েমেনে মার্কিন বাহিনী ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে অবকাঠামো ও বেসামরিক এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলে যে বাধা তৈরি করছিল, সেখান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের এক হামলায় নিহত হয়েছেন হুতি প্রধানমন্ত্রী আহমেদ আল-রাহাওয়িসহ কয়েকজন মন্ত্রী।

ইরানের প্রতিরোধ সক্ষমতা একসময় ভীতিকর বলে পরিচিতি পেলেও এখন সেই শক্তি নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। এখন ইরাকের ক্ষেত্রেও মনে হচ্ছে ইরানের প্রভাব টালমাটাল অবস্থায় পড়েছে। পপুলার মবিলাইজেশন ফোর্সেসের (পিএমএফ) মধ্যে ইরান-ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণ আনার জন্য ইরাক সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে। পিএমএফ শিয়াদের আধিপত্যে গতি আধা সামরিক বাহিনীগুলোর একটি জোট।

যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে পিএমএফকে ইরাকি সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করতে। কিন্তু এই দাবি পূরণ যেমন কঠিন, আবার ঝুঁকিপূর্ণও। যদি সেটি অর্জন করা যায়, তাহলে ইরাকের রাষ্ট্র ও সার্বভৌমত্ব আরও শক্তিশালী হতে পারে।

পিএমএফের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের মধ্যেই ইরাকের একটি বড় সংকট লুকিয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান—দুই পক্ষের চাপ সামলাতে গিয়ে ইরাককে স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব অর্জনের জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করে চলতে হচ্ছে।

২০১৪ সালে আইএসআইএল (ইসলামিক স্টেট অব ইরাক ও লেভান্ত) উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে এসব আধা সামরিক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। ইরাকে নিরাপত্তাশূন্যতার সরাসরি ফল ছিল এই উত্থান। ২০০৩ সালে মার্কিন আগ্রাসনের পর ইরাকি সেনাবাহিনী ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। নতুন করে গড়ে তোলা বাহিনীর না ছিল মনোবল, না ছিল প্রস্তুতি।

আইএসআইএলের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে যেখানে ইরাকের নিয়মিত সেনাবাহিনী ব্যর্থ হয়েছিল, সেখানে পিএমএফ সফল হয়েছিল; কিন্তু সময়ের সঙ্গে পিএমএফের অনেক সদস্যকে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড নিজেদের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য কাছে টেনে নিয়েছিল।

২০০৬ সালের সহিংসতার বিভীষিকা আবারও জেগে উঠতে পারে, আর যুদ্ধক্লান্ত ইরাক আবারও গৃহযুদ্ধের পথে হাঁটা শুরু করতে পারে। তবে ইরাকি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এই ঝড় সামাল দিতে পারে, তাহলে এটি শক্তিশালী সার্বভৌম রাষ্ট্রের পথে এগোনোর সুযোগ তৈরি হবে। ২০০৩ সালে মার্কিন আগ্রাসনের পর থেকে ইরাকি রাষ্ট্রে সেটি দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত।

বর্তমানে পিএমএফ ইরাকের ব্যাপক প্রভাবশালী। এই জোটে এমন গোষ্ঠী আছে যারা সত্যিই ইরাকি সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত হয়ে যেতে চায়, আবার এমন কট্টরপন্থী গোষ্ঠীও আছে যারা প্রশ্নহীনভাবে ইরানের প্রতি অনুগত।

একদিকে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-সুদানির ওপর আধা সামরিক গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম বিলুপ্ত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বাড়ছে। অন্যদিকে নিজের জোট সরকারের ভেতরে তিনি ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়ছেন। তার কারণ হলো তাঁর জোটে পিএমএফের প্রতি নিরেট সমর্থন রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত সমাধানটি হলো পিএমএফের যেসব গোষ্ঠী ইউনিট নিয়মিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত হতে রাজি, তাদের সেনাবাহিনীতে সম্পৃক্ত করা এবং আধা সামরিক নেতাদের ক্ষমতা থেকে সরানো। এটি কোনো সাধারণ পরিবর্তন নয়; বরং ইরাকের নিরাপত্তাকাঠামোর খোলনলচে বদলে ফেলা।

এর বিপরীতে ইরাকের কিছু আইনপ্রণেতা এমন আইন প্রণয়নের চেষ্টা করেছেন, যাতে পিএমএফ স্থায়ী ও স্বাধীন সামরিক বাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

গত মার্চে ইরাকের পার্লামেন্টে উত্থাপিত একটি বিলে পিএমএফকে অস্থায়ী থেকে স্থায়ী বাহিনীতে উন্নীত করার প্রস্তাব তোলা হয়। বাহিনীটির নিজস্ব বাজেট, কমান্ড কাঠামো ও সামরিক একাডেমি থাকার প্রস্তাব তোলা হয়। এমনকি পিএমএফ কমান্ডারদের মন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়ার কথা বলা হয়। এই বিল ওয়াশিংটনের চোখে ইরাক সরকারের ভেতরে ইরানি প্রভাব প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার শামিল।

মার্কিন চাপ এখনকার মতো পার্লামেন্ট থেকে বিলটি প্রত্যাহার করাতে সফল হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও স্পষ্ট হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, এ রকম আইন পাস হলে যুক্তরাষ্ট্র-ইরাক সম্পর্ক পূর্ণাঙ্গভাবে পুনর্মূল্যায়ন করা হবে; এর মধ্যে সম্ভবত নিষেধাজ্ঞাও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। সম্প্রতি ইরাকের ওপর ওয়াশিংটন যে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই হুঁশিয়ারির গুরুত্ব বেড়ে গেছে।

মার্কিন চাপে জুন মাসে পিএমএফ–যোদ্ধাদের বেতন বিতরণ ব্যাহত হয়। ইরাকের রাষ্ট্রায়ত্ত আল-রাফিদাইন ব্যাংক ইলেকট্রনিক লেনদেনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করেনি।
আল-রাফিদাইন ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানান মার্কিন আইনপ্রণেতারা। ২০২২ সালের এক দুর্নীতির ঘটনায় ২৫০ কোটি ডলার রাষ্ট্রীয় তহবিল আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছিল। সেই কেলেঙ্কারিতে পিএমএফ-ঘনিষ্ঠদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছিল।

পিএমএফ বর্তমান অবস্থায় থাকবে কি না, এই প্রশ্ন এখন আর বাগদাদে আলোচনার বিষয় নয়। এই প্রশ্নের জবাব ইতিমধ্যেই ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। একটি ইরানপন্থী সমান্তরাল বাহিনীকে ইরাকি রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে জায়গা দেওয়ার কারণে আল-সুদানি প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছেন।

এখন ইরাক যে পথে এগোচ্ছে, সেটি স্পষ্ট। ইরানের মিত্রদের প্রভাবিত ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিতে ভরা একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা এখন মার্কিন চাপে মৌলিক রূপান্তরের মুখোমুখি। তেহরানের শেষ বড় আঞ্চলিক ঘাঁটি এখন অবরুদ্ধ। ওয়াশিংটন ফলাফলকে নিয়তির ওপর ছেড়ে দিতে চাইছে না।

আল-সুদানি শেষ পর্যন্ত মার্কিন চাপের কাছে নতি স্বীকার করবেন। এর কারণ হলো তার কাছে কোনো কার্যকর বিকল্প নেই। পিএমএফের যে অংশটি তেহরান থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে রাজি হবে, তারা ইরাকের নিয়মিত সেনাবাহিনীতে একীভূত হবে। আর যারা সেটি করতে অস্বীকৃতি জানাবে, তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে এবং অর্থসংস্থান বন্ধ করা হবে। এটি এখন আর ‘যদি কিন্তু’র মধ্যে সীমিত নেই।

কিন্তু এর ঝুঁকিও অনেক। ইরানের প্রতি অনুগত আধা সামরিক গোষ্ঠী সহিংস প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। ইরান যদিও এখন আঞ্চলিকভাবে দুর্বল, তবুও ইরাকজুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টির সক্ষমতা দেশটির আছে।

ফলে ২০০৬ সালের সহিংসতার বিভীষিকা আবারও জেগে উঠতে পারে, আর যুদ্ধক্লান্ত ইরাক আবারও গৃহযুদ্ধের পথে হাঁটা শুরু করতে পারে। তবে ইরাকি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এই ঝড় সামাল দিতে পারে, তাহলে এটি শক্তিশালী সার্বভৌম রাষ্ট্রের পথে এগোনোর সুযোগ তৈরি হবে। ২০০৩ সালে মার্কিন আগ্রাসনের পর থেকে ইরাকি রাষ্ট্রে সেটি দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত।

  • জাসিম আল-আজ্জাউই | সাংবাদিক ও বিশ্লেষক
  • মূল প্রতিবেদন আল-জাজিরা থেকে সংগৃহীত, ইংরেজি থেকে অনূদিত

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Previous Story

ফিলিস্তিনি সাংবাদিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে কী ভাবছেন ইসরায়েলি গণমাধ্যমকর্মীরা?

Next Story

ইরান–আমেরিকার ‘দ্বিতীয় যুদ্ধ’ ঘনিয়ে আসছে চারটি কারণে

Previous Story

ফিলিস্তিনি সাংবাদিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে কী ভাবছেন ইসরায়েলি গণমাধ্যমকর্মীরা?

Next Story

ইরান–আমেরিকার ‘দ্বিতীয় যুদ্ধ’ ঘনিয়ে আসছে চারটি কারণে

Latest from Blog

আলি আমজদের ঘড়িঘর

সরোজ কান্তি দেওয়াঞ্জী , সিলেট শহরের কোর্ট পয়েন্টে, সুরমা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে এক পুরোনো সাক্ষী—আলি আমজদের ঘড়িঘর।যে ঘড়িঘর দিনের আলোয় সময় বলে, আর রাতে শহরের নিস্তব্ধতায় অতীতের গল্প শোনায়। বলা হয়,

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে

জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর ২০২৫ অনুষ্ঠানকে ঘিরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার (১৫ অক্টোবর) বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে এ বৈঠক

কিছু উপদেষ্টা ষড়যন্ত্রে জড়িত, তাদের কণ্ঠ রেকর্ডসহ প্রমাণ রয়েছে: তাহের

অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা প্রশাসনে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর অনুগতদের বসিয়ে ‘পরিকল্পিত নির্বাচন’ আয়োজনের ষড়যন্ত্র করছেন বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি দাবি করেছেন, এ ষড়যন্ত্রে

শাপলার পরিবর্তে নতুন প্রতীক নির্বাচনে এনসিপিকে সময়সীমা নির্ধারণ করল ইসি

জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) শাপলা প্রতীক দেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ। তিনি বলেন, আগামী ১৯ অক্টোবরের মধ্যে দলটিকে শাপলার বিকল্প প্রতীক বেছে নিতে হবে। মঙ্গলবার

ঝটিকা মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককে দেওয়া হচ্ছে ৫ হাজার টাকা

আওয়ামী লীগের কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ রয়েছে, আর সেই অর্থ ব্যবহার করে তারা আসন্ন নির্বাচনকে ভণ্ডুল করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত দলের সদস্যদের ঝটিকা মিছিলে অংশ নিতে প্রলুব্ধ করতে
Go toTop

Don't Miss

আলি আমজদের ঘড়িঘর

সরোজ কান্তি দেওয়াঞ্জী , সিলেট শহরের কোর্ট পয়েন্টে, সুরমা নদীর

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে

জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর ২০২৫ অনুষ্ঠানকে ঘিরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের